চা শ্রমিক ডট কম,বিরসার জন্ম উনিশ শতকে আশির দশক। উনিশ শতকের গোঁড়ারদশকের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোই ছিল বিরসার আবির্ভাবের ক্যানভাস। তখন কৃষক ও দিনমজুরদের ভোগান্তির অন্ত ছিলনা। একদিকে ইংরেজ সরকারের শাসন, অন্যদিকে জমিদারের অত্যাচার। আর দু’দিক দিয়েই আর্থিক ও দৈহিক শোষণ। রক্তচোষা বাদুড়ের মতো শরীরের সমস্ত শক্তি চুষে ফেলত সাহেবরা। বেগার খাটা, জমি থেকে বেদখল করে দেওয়া ছিল রোজকারঘটনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ছিল দুর্ভিক্ষ। ছিল মহামারী। বলা হয় জেলে থাকাকালীন বিরসা মুণ্ডাও কলেরায় মারা গেছেন। জঙ্গলের আদিবাসিদের ক্রীতদাসে পরিণত করতে চেয়েছিল সাহেবরা। কিন্তু তারা সফল হয়নি।আদিবাসিরা বরাবরই স্বাধীনচেতা। পরাধীনতার বেড়ি ছিঁড়ে তারা বরাবর বেরোতে চেষ্টা করত। তারা স্বাধীনতার লাভের জন্যে চোয়াল শক্ত করে লড়াই করছিল। লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে ও লড়াইয়ের হার জিত দিয়ে তারা আগামী দিনের কোন বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জমিদার ও জাগিরদারদের হাতে নির্যাতলের জ্বালার নির্যাস থেকে তৈরি হচ্ছিল গণচেতনার বীজ। বিরসার আন্দোলন সেই বীজটির অঙ্কুর।ঝাড়খণ্ডের মূলতঃ রাঁচি, লোহারদাগা ও গুমলা অঞ্চলে মুণ্ডানামের এক জনজাতি বাস করে। আদিবাসি সমাজে মুণ্ডা মানে গ্রামের মোড়ল। পেশাগত ভাবে মুণ্ডারা ছিলেন গ্রামের মুখিয়া বা মাথা। তখনকার সমাজে মুণ্ডা নামটির সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা জড়িয়ে থাকত। তেমনি পাহাড়িয়াজনজাতির লোকেদের সরদার বলা হল। সরদারদের হাতে এক একটা বড়সড় এলাকার তদারকির ভার থাকত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমিদারদের ‘দেওয়ানি’ অধিকার কেড়ে নেওয়ার ফলে সরদারদেরও আধিকার খর্ব হয়। মুণ্ডাদের ঘন ঘন বিদ্রোহ ও সরদারদের বিদ্রোহ ১৭৮৯ সাল থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত চরমে ছিল। জমিদাররাও নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করত। কিন্তু আদিবাসিদের গণচেতনা ছাই ঢাকা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলত। বারেবারে বিদ্রোহ হত। বিশেষ করে ১৮১১, ১৮১৯-২০ ও ১৮৬২ সালে জমিদারদের বিরুদ্ধে মুণ্ডাদের বিদ্রোহ ব্যাপক রূপ নিয়েছিল।বলা বাহুল্য, ইংরেজ শাসকরা ছিল চতুর। ওরা বশ্যতা স্বীকার করা হিন্দু ও মুসলমান জমিদারদের প্রচুর সাহায্য করত। সাহায্য পেয়ে অনেক জমিদার ফুলে ফেঁপে উঠল। পরোক্ষে ইংরেজরাই শক্তিশালী হত। ইংরেজ শাসকরা থখন শুধু জমিদারদেরইপক্ষে দাঁড়াত। আদিবাসিদের সুখ দুঃখ, অভাব অনটন ও রোগ ভোগ নিয়ে ইংরেজ শাসক আর তাদের অফিসারদের কোন মাথাব্যথা ছিলনা।সুবিধেবাদী বহিরাগত জমিদার বা ‘দিকু’র অধিকাংশই ছিল ভোগী। তাদের স্ফূর্তি কারা ছেড়ে আদিবাসিদের কথা শোনার সময় ছিলনা।রাঁচি অঞ্চলে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ ও বহিরাগত জমিদারদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি মুণ্ডাদের অসহ্য লাগছিল। তার সঙ্গে সাদা সরল আদিবাসিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন, আর্থিক ও শারীরিকশোষণ সংক্রান্ত অভিযোগ মনের মধ্য গুমরে থেকে বারুদের কাজ করছিল। জাগিরদার ও জমিদাররা ইংরেজদের কাছ থেকে বিশাল বিশাল ভূকন্ডের মালিকানা আদায় করত। কখনো সৈন্যশিবির করার জন্যে জায়গার আবদারে কখনো বা মন্দির, মসজিদ বা গির্জাঘর করার নামে। এর ফলে জঙ্গলের পর জঙ্গল, গ্রামের পর গ্রাম চলে যেত জমিদারদের দখলে। পাহাড়, নদী ও রাস্তাও হয়ে যেত জমিদারদের। আদিবাসিরা জমি থেকে বেদখল হয়ে যেত। জঙ্গল ছেড়েপালাল অনেকে। জঙ্গলের অধিকার খর্ব হল। মুণ্ডারা এই ব্যবস্থাও সহ্য করতে পারতনা।বিদ্রোহের কারণ যতই গুরুতর হোক না কেন, বা মুণ্ডারা যতই ঘন ঘন বিদ্রোহ করুক না কেন, বিভিন্ন সময় জুড়ে মুণ্ডাবিদ্রোহ ওদের জন্যে কোল সুফল আদায় করতে পারেনি। বরং তারা আরও কঠিন দুরাবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। ওদিকে ইংরেজ শাসকের সুরক্ষার মোড়কে জমিদাররা দিব্যি খোসমেজাজে দিন কাটাচ্ছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্যে ইংরেজদের কাছ থেকে সৈন্যসাহায্য পেয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো জমিদাররা বছরের পর বছর আদিবাসিদের ভয় সিঁটকে থাকছে। আবার সুযোগ পেলে নির্মম ভাবে বিদ্রোহ দমন করতে অত্যাচারী হয়ে উঠছে। প্রতিশোখস্পৃহায় অনেক জমিদারের জিভ লকলক করত।এরপর শুরু হল সরদার আন্দোলন। ১৮৫৯-৮১ সাল পর্যন্ত চলে সরদার আন্দোলন। সরদারদের লড়াইয়ের নাম ছিল ‘মুলকি লড়াই’। জমিদারদের ক্ষমতাচ্যূত করে বিতাড়িত করারই নাম ছিল মুলকি লড়াই। সরদাররা জমিদারদের অস্বীকার করতে শুরু করল। জমির খজনা দিতেও অস্বীকার করল।তাদের কথায়, তাদের পূর্বপুরুষের জমিজমায় দিকুরা অধিকার ফলায় কোন সাহসে! তারা বলত জমি, জঙ্গল আর জল তাদের ছিল। তাদেরই থাকবে। শুধু তাড়াতে হবে দিকুদের। তারা জানত একমাত্র তারাই তাড়াতে পারবে দিকুদের। কৃষকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল। ১৮৫৮ সাল থকেই সরদাররা মারমার-কাটকাট লাগিয়ে দিয়েছিল। জমিদাররাও বুঝতে পারছিল যে এ আগুন সহজে নিভবার নয়। আদিবাসিরা যুগ সুগ ধরে অভিযোগ পুষে রেখেছিল। আজ তা বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছে। ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। জমিদারদের দখলে থাকা বড় বড় ভূখন্ড সরদারদের দখলে চলে এল। সেইসময়ে সরদাররা ব্যাপক মুক্তাঞ্চল জুড়ে স্বঘোষিত এক স্বাধীন রাজ্যের পত্তন করেছিল।এই রকম ভাবেই চলছিল। বারে বারে বিদ্রোহ দমন করা হচ্ছিল। ১৮৯০ সাল নাগাদ সরদার আন্দোলন একটি রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় সংগঠিত হতে শুরু করল। আদিবাসিরা এই সময়ে জমি আদায়ের জন্যে আইনের দ্বারস্থ হয়।ঠিক এই সময়ে আবার একদল সরদার নিজেদের বিদ্রোহী ঘোষিত করল। ইংরেজরা এই সমস্ত বিদ্রোহীদের নাম দিল ‘নিও সরদার’। নিও সরদাররা তখনকার সংবিধানের তোয়াক্কা করতনা। ইংরেজ শাসকের আইন অমান্য করত। তারা মনে করত জমিদার নয়, ইংরেজ শাসকরাই তাদের যাবতীয় দুঃখ দুর্দশার কারণ। জমিদাররা তো ইংরেজদের প্রশ্রয় পেয়ে শক্তিশালী। ইংরেজরা না থাকলে জমিদারদের শক্তিও আপনা আপনি কমে যাবে। তাই নিও সরদাররা মনে করত ইংরেজরা তাদের পয়লা নম্বরের শত্রু। ইংরেজ শাসক ও তাদের অফিসাররা দেশ থেকে বিতাড়িত হলে তাদের কষ্ট লাঘব হবে। ইংরেজরা দেশ ছেড়ে পালালে স্বাধীনতা ফিরতে বাদ্য। ইংরেজ নাথাকলে জমিদারও থাকবেনা। জমিদাররা তো ইংরেজদের স্বার্থ সিদ্ধির যন্ত্র।নিও সরদারদের লড়াই শুরু হল। এর নাম সরদারি লড়াই।
Leave a Reply